ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল ২৫ বছর বয়সে শিক্ষকতা করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু পরে নিজেকে উৎসর্গ করেন ব্রাত্যজনের সেবায়। নিজের হাতে গড়েছেন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘আপনগাঁও’।
যুক্তরাষ্ট্রের ছোট্ট দ্বীপরাজ্য আইওয়ায় ফ্র্যাঙ্ক ও মেরি দম্পতির ঘরে ১৯৩৭ সালের ১ নভেম্বর জন্ম ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজালের। চার ভাই ও এক বোনের সংসার ছিল ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজালের। আশপাশের বিভিন্ন মানুষকে অকাতরে সাহায্য করছেন তার বাবা-মা। তাদের বাড়ির পাশেই বাস করত মাদকাসক্ত এবং দরিদ্র এক লোক। একবার বড়দিনের সময় চারদিকে উৎসবের আয়োজন চলছে। কিন্তু মাদকাসক্ত ওই ব্যক্তির ঘরে উৎসবের লেশমাত্র নেই। ছোট্ট শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে মা মেরি গেলেন মাদকাসক্ত ব্যক্তির ঘরে তাঁকে উপহার দেয়ার জন্য। দিলেন নতুন কাপড়। উপহার পেয়ে লোকটির চোখমুখে কৃতজ্ঞতা আর হাসি যা পরে তাকে অনুপ্রাণিত করে মানুষের জন্য কিছু করার। পরবর্তী সময়ে তিনি বদলে দিয়েছেন শত শত মাদকাসক্ত মানুষের জীবন।
মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার মহৎ কাজটি তিনি করছেন বাংলাদেশে। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে তাঁর মাদকাসক্ত পুনর্বাসনকেন্দ্র।
বাংলাদেশে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। গাজীপুরের নাগরী হাইস্কুলেও কাজ করেছেন। প্রথম থেকেই তাঁর আবাস ছিল আসাদগেটের সেন্ট জোসেফ স্কুলে। হঠাৎ একদিন মোহাম্মদপুর টাউন হলে কিছু ছেলেকে মাদক নিতে দেখলেন তিনি। এক দিন, দুই দিন—প্রতিদিনই একই ঘটনা ঘটতে থাকল। এর মধ্যে শুনলেন, তেজগাঁও এলাকায়ও দেদার মাদক নিচ্ছে তরুণেরা। ব্যস, নিজের কাজটি ঠিক করে ফেললেন ব্রাদার রোনাল্ড। ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো গড়ে তুললেন মাদকাসক্ত পুনর্বাসনকেন্দ্র। ১৯৯৪ সালে বড় পরিসরে যাত্রা শুরু হয় ‘আপন’-এর। অভিজ্ঞতা নিতে ভারত ও নেপালের বিভিন্ন মাদকাসক্ত পুনর্বাসনকেন্দ্রের কার্যক্রমও দেখে এসেছেন।
বাংলাদেশে প্রথম মাদকাসক্ত পুনর্বাসনকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল। তাঁর মাদকাসক্ত পুনর্বাসনকেন্দ্রের নাম ‘আপন’। তিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালক। ১৯৯৪ সালে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটিকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন ব্রাদার রোনাল্ড, ওই সময় ‘আপন’ ছিল ইকবাল রোডে। প্রথমে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে শুরু হয় ‘আপন’-এর কার্যক্রম। মাত্র ২০ হাজার টাকা সম্বল করে কাজে নেমেছিলেন। দিনে দিনে সদস্যসংখ্যা বাড়তে থাকল। ফলে ইকবাল রোড থেকে ‘আপন’ স্থানান্তরিত হলো শাহজাহান রোডে। এরপর সদস্যসংখ্যা যখন ২০ ছাড়িয়ে গেল, তখন আরেকবার ডেরা বদল, আবার ইকবাল রোডে।
নিজের হাতে গড়া তাঁর পুনর্বাসনকেন্দ্রের সবাই তাঁর কাছে সন্তানের মতো। ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজালের প্রতিদিনের দিনরাত্রির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে পথশিশু থেকে পূর্ণবয়স্ক। একসময় এরা সবাই ছিল মাদকাসক্ত। এখন নতুন জীবনের আশায় স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছে ‘আপন’-এ।
১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জাইল্লা গ্রামে ‘আপন’-এর জন্য তিন একর জায়গা কেনেন ব্রাদার রোনাল্ড। ২০০৭ সালে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় তাঁর স্বপ্নের ‘আপনগাঁও’। ‘আপন’-এর নতুন ঠিকানাকে ভালোবেসে সবাই নামকরণ করেছেন ‘আপনগাঁও’। দারুণ সুন্দর পরিবেশে গড়ে উঠেছে এ আপনগাঁও। বিশাল খোলা প্রান্তর, চারদিকে শুধু অবারিত সবুজ আর সবুজ, আছে আদিগন্ত ধানখেত। তার মাঝখানে দুটো দালান। দালান দুটো নির্মাণে সহায়তা দিয়েছে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও সামিট গ্রুপ। বর্তমানে ২০৬ জন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে পুনর্বাসন-সহায়তা দিচ্ছে ‘আপন’। এর মধ্যে ১২৪ জন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ এবং ৬০ জন শিশু ছাড়া ২০ জন মেয়েও রয়েছে। প্রতিটি মাদকাসক্ত ব্যক্তি দুই বছর ‘আপন’-এর তত্ত্বাবধানে থাকেন।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস